২৭ নভেম্বর ১৯৮৩ দুর্গাপুরের ইতিহাসে একটি সোনালি দিন। সুর সাম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরকে ওই দিনে দুর্গাপুরের সঙ্গীত প্রেমী মানুষ সামনে থেকে দেখার সুযোগ পান। দুর্গাপুরে একসময় সংস্কৃতি জগতের মানুষজনদের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রচুর মুম্বাইয়ের শিল্পীদের জলসা হত দুর্গাপুরে। দুর্গাপুরের মানুষের সঙ্গে সেই সূত্রে মুম্বাইয়ের নামিদামি শিল্পীদের একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রেই লতা মঙ্গেশকরের একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিল দুর্গাপুরের সঙ্গীত প্রেমী মানুষের। লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণের খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গাপুরের সঙ্গীত প্রেমী মানুষের সঙ্গে দুর্গাপুরে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গীতানুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ক্লাব স্টিল টাউনশিপের হোস্টেল অ্যাথেলেটিক ক্লাবের সদস্যদের সকলেই শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েন। যদিও সেই সময়ের ক্লাবের বেশির ভাগ সদস্যই বতর্মানে আর নেই। যারা আছেন তাঁরা বেশিরভাগ পরের প্রজন্মের।
রবিবার হোস্টেল অ্যাথেলেটিক ক্লাবের সদস্যরা ক্লাবের সামনে লতাজীর স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন এবং এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। খুব শিগগিরই লতা মঙ্গেশকরের স্মরণে একটি স্মরণসভা করার কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিচারনায় ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ সুব্রত রুদ্র বলেন ১৯৮৩ সালের ২৭ নভেম্বর আমাদের ক্লাবের মাঠে লতা মঙ্গেশকর এসেছিলেন। তখন আমার বয়স ১৪ বছর। আমার অগ্রজদের সান্নিধ্য পেয়ে খুব কাছ থেকে সমগ্র অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেছিলাম। ক্লাবের নাম ছিল তখন স্টিল হোস্টেল স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব। পরবর্তী সময়ে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। ক্লাবের কার্যকরী সভাপতি অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সম্পাদক ছিলেন স্বর্গীয় ইন্দ্রজিৎ সেন। সুব্রতবাবু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন লতা মঙ্গেশকরের স্মৃতি চারণ করতে করতে। তিনি বলেন, ‘কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে লতাজীর সঙ্গীতানুষ্ঠানটি হয়। অনুষ্ঠানের ১৫ দিন আগে থেকেই প্রশাসনের কড়া নজরদারি শুরু হয়। ক্লাবের সঙ্গে লতাজীর চুক্তিপত্র পর্যন্ত ভেরিফিকেশন করে দেখা হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তারপর অনুষ্ঠানের আয়োজন অনুমতি মেলে। অনুষ্ঠানের প্রতিটি পদক্ষেপ প্রশাসনের নজরদারি তে হয়। ১০ নভেম্বর লতা মঙ্গেশকরের দুই বোন উষা মঙ্গেশকর ও মীনা মঙ্গেশকর আসেন মাঠ পরিদর্শন করতে। কোথায় কি ব্যবস্থা করা হয়েছে তা পরখ করতে। সঙ্গে মহাকরণ, লালবাজার থেকে পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ লোকজন মাঠ ঘুরে দেখেন। সেদিন মাঠে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। লতা মঙ্গেশকর কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণ করে সোজা গাড়ি করেই দুর্গাপুরে আসেন। দুর্গাপুর গেস্ট হাউসে ছিলেন। সেখান থেকে মঞ্চে উপস্থিত হন রাত ১০ টা ০১ মিনিটে, সামান্য কয়েকটি কথা বলেই পরপর ২৯ টি জনপ্রিয় গান শোনান দর্শকদের। তারপর ঘড়ির কাঁটায় একটা বাজতেই মঞ্চ থেকে নেমে পড়েন সুর সাম্রাজ্ঞী।কুড়ি হাজার আসন সংখ্যা থাকলেও শেষমেষ অনুষ্ঠানস্থলের টিনের বেড়া খুলে দিতে হয় ভিড়ের চাপে। টিকিট সাতদিন আগেই শেষ হয়ে যায়। যারা টিকিট কাটার সুযোগ পাননি, সেইসব দর্শক টাউনশিপের রাস্তায় বসে গান শোনেন সুরের সরস্বতীর। গোটা টাউনশিপ জুড়ে আলোক স্তম্ভে মাইক বাঁধা হয়েছিল বলে মনে পড়ে। চেয়ারের টিকিটের মূল্য ছিল ১০০ টাকা। ছিল গ্যালারি ও ফরাসে বসার ব্যবস্থা। সব ভরে যায়। লতা মঙ্গেশকরের গানের মূর্ছনায় ভেসে যায় দুর্গাপুর। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ছিলেন সেদিন ভূপেন হাজারিকা, এসপি বালাসুব্রামনিয়াম, জনি ওয়াকার, নিতিন মুকেশের মতো শিল্পীরা। সেই সব স্মৃতি অক্ষুন্ন রেখেই আমাদের ক্লাবকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বলে নতুন প্রজন্মের সদস্যদের কাছে বক্তব্য রাখেন সুব্রত রুদ্র।