কালনাগিনীই এখানে সাক্ষাৎ গ্রাম্যদেবী, আষাঢ় মাসের কৃষ্ণ প্রতিপদ তিথিতে এই বিষধর সর্পকূলই পুজিত হয় দেবী ঝঙ্কেশ্বরী রুপে, প্রায় পাঁচশো বছর ধরে এই জীববৈচিত্র্য রক্ষিত হয়ে আসছে মঙ্গলকোটে।
বহুপ্রাচীন বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেই উৎসবে মেতে ওঠে একটা সম্পূর্ণ গ্রাম। চরম বিষধর কালিনাগিনী এখানে জীবন্ত দেবী। সেই দেবীর পুজোকে ঘিরেই হয় উৎসব। ভাতাড় ও মঙ্গলকোটের মশারু, পলসোনা, ছোট পোষলা ও বড়পোষলা গ্রামের বাসিন্দারা সাপ বলেন না, সাপ এখানে দেবী ঝাঁকলাই বা মা ঝঙ্কেশ্বরী নামে পুজিত হন। প্রায় পাঁচশ বছরের প্রাচীন পুজো মঙ্গলকোটের চার গ্রামের নিজস্ব উৎসব হিসেবেই পালিত হয়। ঝাঁকলাই দেবীর পুজোকে ঘিরে আশপাশের গ্রামের প্রচুর ভক্ত ভিড় জমান এই গ্রামগুলোতে।
বিষধর সাপ যিনি গ্রামবাসীদের কাছে সাক্ষাৎ ঝাঁকলাই দেবী গ্রামের রাস্তায়, বাড়ির উঠোনে, ঘরের আনাচে-কানাচে অনায়াসে ঘুরে বেড়ায়। মানুষের সঙ্গে বিষধর সাপের এই অদ্ভুত সহাবস্থান দেখতে প্রচুর মানুষ ভিড় জমান ভাতাড় ও মঙ্গলকোটের এই গ্রামগুলোতে। এখানকার এই বিশেষ সাপ দেখতে বিষধর কেউটে প্রজাতির হলেও তার কামড়ে মৃত্যু হয় না বলে গ্রামবাসীদের বিশ্বাস। কালো মাথার পিছন দিকে একটি চক্র আছে, ল্যাজের দিকটা একটু কাটা, কিন্তু গতি শ্লথ। এই সাপ কামড়ালে কেন বিষ হয় না তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি। দু’দশক আগে সর্প বিজ্ঞানীরা গ্রামে এসে পরীক্ষা করলেও সাপ ধরে ল্যাবরেটোরিতে নিয়ে যেতে পারেননি। গ্রাম্য বিধিতে এখানে সাপ ধরা বা মারা যাবে না। এই চার গ্রামে বেদে সম্প্রদায়ের প্রবেশ নিষেধ। কেউ যদি সাপ মারে তাঁর জরিমানা করা হয়। গ্রামবাসীদের দাবি এখানকার সাপ কাউকে সহজে কামড়ায় না। যদি কখনও সাপ কোন গ্রামবাসীকে দংশন করে তাহলে তাঁকে দেবীর প্রসাদ হিসেবে মেনে নিয়ে দেবীর নামাঙ্কিত একটি পুকুরের মাটি ও জল ক্ষত স্থানে লাগিয়ে নিলেই আর বিষ হয় না বলেই গ্রামবাসীদের বিশ্বাস। এমনকি সাপের মৃত্যু হলেও দেহ গঙ্গায় দিয়ে সৎকার করার রেওয়াজ প্রচলিত আছে গ্রামে। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস এই সাপকে পুজো করলে গ্রাম রক্ষা পাবে। অনেক বিপদ এমনকী প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে গ্রামবাসীরা রক্ষা পান।
ঝাঁকলাই দেবীর নামের সঙ্গে অনেক লোককথা মিশে আছে। শাস্ত্রীয় মতে এই সর্পদেবী আদতে কালনাগিনী। মনসামঙ্গলের কাহিনি অনুসারে লখিন্দরকে দংশনের পর বেহুলার শাপগ্রস্থ হয়ে কালনাগিনী নির্বিষ সাধারণ সাপ হিসেবে মর্ত্যের গহ্বরে বসবাস করছে। দেবীর স্বপ্নাদেশে আনুমানিক ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে পলসোনার ভূমিপুত্র পণ্ডিত মুরারি চক্রবর্তী ঝাঁকলাই দেবীর প্রস্তর মূর্তি মাঠ থেকে তুলে এনে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করেন। আষাঢ় মাসের কৃষ্ণ প্রতিপদ তিথিতে সাপকে এখানে দুধ, কলা, ফুল সহযোগে সিঁদুর মাখিয়ে ব্রাহ্মণ পুজো করেন। বাড়ির উঠোন, শোওয়ারর ঘর, রান্না ঘর, ঠাকুর ঘরেও ঝাঁকলাইয়ের অবাধ যাতায়াত। এই চার গ্রামে অন্য কোন প্রজাতির সাপের দেখা মেলেনা এবং রাত্রিকালে দেবী ঝাঁকলাই রাস্তায় বের হন না বলে দাবি গ্রামবাসীদের।