জেলার অন্যতম প্রাচীন বনেদি পরিবারের পুজো হল দুর্গাপুরের পানাগড়ের সোঁয়াই গ্রামের মুখার্জী পরিবারের দুর্গাপুজো। এবার ৩২৯ বছরে পড়ল এই পুজো। মুখার্জী পরিবারের প্রাণপুরুষ বাসুদেব মুখার্জী এই পুজোর সূচনা করেন। পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত মায়ের পুজো যাতে ধুমধামের সঙ্গে হয়, তাই বর্ধমানের মহারাজা একসময় সোঁয়াই গ্রামের মুখার্জী পরিবারের হাতে জমি, পুকুর সহ প্রচুর সম্পত্তি দান করেছিলেন।
বর্তমানে পরিবারের সদস্যরা অনেকেই কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন, কিন্তু দুর্গাপুজোর সময় প্রতিবছরই পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই গ্রামে চলে আসেন মায়ের পুজোর টানে। মায়ের পুজোতে সকলেই অংশগ্রহণ করেন। পুজো উপলক্ষে পুজোর প্রথম তিন দিন গ্রামের মানুষের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না। পুজোর আনন্দ উপভোগ করতে এই মুখার্জী পরিবারের মন্দিরে বসে প্রসাদ গ্রহণ করেন। নবমীর পুজোতে মুখার্জী পরিবারের রীতি মেনে মায়ের নামে আখ, ছাগ, মোষ উৎসর্গ করা হয়। প্রচুর ভক্ত সমাগম হয় এই ছাগ ও মোষ বলিদান চাক্ষুষ করতে। নবমীর পর বিজয়ার রীতি মেনে পরিবারের মহিলা সদস্যরা মাকে চোখের জলে বিদায় জানান।
মুখার্জী পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, সোঁয়াই গ্রামে যখন এ পুজোর সূত্রপাত হয় তখন দিল্লির মসনদে বসে আছেন ঔরঙ্গজেব। সময়টা ইংরাজি ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দ। বাংলার ১১০০ সন। সেই সময়ে বর্ধমানের সোঁয়াই গ্রামে থাকতেন মুখোপাধ্যায় পরিবারের পূর্বপুরুষ বাসুদেব মুখোপাধ্যায়। তিনি আদপে ছিলেন ফরিদপুরের মানুষ। কিন্তু টোলে পড়াশোনা করতে তাঁর সোঁয়াই গ্রামে আসা। তারপর এই গ্রামেরই মেয়েকে বিয়ে করে এখানে থাকতে শুরু করেন। এই বাসুদেব মুখোপাধ্যায় একদিন হঠাৎই স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নাদেশে মা দুর্গা তাঁকে বলেন, তিনি অপূজিত অবস্থায় ফরিদপুরে পড়ে আছেন। এই স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর আর সময় নষ্ট করেননি বাসুদেববাবু। তিনি তাঁর ৩ পুত্র ও পরিবারের অন্যদের নিয়ে সোজা চলে যান বাকলসার কাছে ফরিদপুরে তাঁর পৈতৃক ভিটেয়। তারপর তাঁর পারিবারিক দুর্গার কাঠামো কাঁধে করে সোঁয়াই গ্রামের দিকে পা বাড়ান।
যখন প্রায় সোঁয়াই গ্রামের কাছে পৌঁছে গেছেন তাঁরা, সেই সময়ে যে রাস্তা ধরে তাঁরা আসছিলেন সেই রাস্তার উল্টোদিক থেকে বর্ধমানের মহারাজা ভ্রমণ সেরে ফিরছিলেন। রাজা যে পথে যাবেন সেই পথ আগলে কারা এভাবে আসছে তা দেখতে রাজার পাইক, বরকন্দাজ ছোটে। তারা বাসুদেব মুখোপাধ্যায়কে রাস্তা ছেড়ে সরে দাঁড়াতে বলে। কিন্তু বাসুদেববাবু জানিয়ে দেন মায়ের কাঠামো নিয়ে তাঁরা রাস্তা ছাড়বেন না। বরং রাজা সরে দাঁড়ান। মা যাবেন। কিসের এত হাঙ্গামা তা জানতে রাজা এবার স্বয়ং এগিয়ে আসেন। ধর্মপ্রাণা রাজা যেই শোনেন যে মা দুর্গার কাঠামো যাচ্ছে তিনি তৎক্ষণাৎ রাস্তা ছেড়ে সরে দাঁড়ান।
সেখানেই শেষ নয়, এই পুজো যাতে ধুমধাম করে হতে পারে সেজন্য মুখোপাধ্যায় পরিবারকে প্রচুর জমি, পুকুর, সম্পত্তি দান করেন বর্ধমানের মহারাজা। সেই বছরই সেই কাঠামোয় মাটি লেপে তাতে রং করে প্রতিমাকে মৃন্ময়ী রূপ দেওয়া হয়। শুরু হয় পুজো। সেই যে পুজো শুরু হয়েছে তা আজও অমলিন। এ বছর ৩২৯ বছরে পা দিল এই মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজো। আজও চিরাচরিত রীতি মেনে, পুরনো পারিবারিক পুঁথি মেনে হয় পুজো।