কলকাতার দেবাঞ্জন দেব কেলেঙ্কারির রেশ মিটতে না মিটতেই এবার কেন্দ্র সরকারের হাইওয়ে সড়ক বিভাগে চাকরি দেওয়ার নাম করে বড়সড় প্রতারণা চক্রের হদিশ পেল পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশ। আর এই প্রতারণা চক্র রীতিমত রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় সহ বিশেষত কেন্দ্র সরকারের উচ্চপদস্থ আমলাদের নাম করে ২০১৬ সাল থেকে রাজ্যের বীরভূম, হুগলী, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব বর্ধমান সহ কয়েকটি জেলা জুড়ে প্রতারণা চক্রের জাল বিছিয়েছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। শুধু তাইই নয়, এই প্রতারণা চক্রের মূল মাথার সঙ্গে বিজেপির একাধিক সাংসদ জড়িত থাকার অভিযোগও তুলেছেন চাকরীপ্রার্থীরা। তাঁরা দাবি করেছেন, তাঁদের জানানো হয়েছিল সংস্থার চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিজেপির একাধিক সাংসদের ভাল যোগাযোগ রয়েছে। চাকরি নিশ্চিত। এই ঘটনায় গোটা বিষয়টি নিয়ে বর্ধমান থেকে কলকাতা পর্যন্ত তোলপাড় শুরু হতে চলেছে।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের মিনিস্ট্রী অফ রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড হাইওয়েজ দফতরে চাকরি দেওয়ার নাম করে এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩ হাজার ছেলেমেয়ের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ওই প্রতারক চক্রের। যেখানে রাজ্যপালের ছবি দেখিয়ে চাকরীপ্রার্থীদের আকৃষ্ট করার অভিযোগও উঠেছে। বর্ধমানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কল্যাণ সিংহ রায় জানিয়েছেন, সোমবার বিকালে তাঁরা খবর পান মেমারি থানার পালসিট এলাকার ইণ্ডিয়ান ধাবা নামে একটি হোটেলে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নেওয়া হচ্ছে। এই খবর পাওয়ার পরই তাঁরা সেখানে হানা দেন। সেই সময় ৩৩ জন বেকার ছেলেমেয়ে সেখানে হাজির ছিল। তাদের কাছ থেকে ৩০০০ থেকে ৩২০০ টাকা করে নিয়ে তাঁদের শপথবাক্যের সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছিল। তিনি জানিয়েছেন, রীতিমত মিনিস্ট্রী অফ রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড হাইওয়েজ দফতরের নামে অশোকস্তম্ভ দেওয়া এই সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছিল। পুলিশ সেখান থেকে গ্রেফতার করে মিহির কুমার দাস, আলি হোসেন, হাসিবুল রহমান, আবুল বাসাদ, রিয়াজুল ইসলাম, ইব্রাহিম সেখ, সামসুর আলম এবং মলয় কর্মকার নামে ৮ জনকে। এদের মধ্যে প্রথম ৬ জনের বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলা নবগ্রাম থানার বিভিন্ন গ্রামে। বাকিদের মধ্যে সামসুর আলম সেখের বাড়ি বীরভূমের নলহাটি থানার গোপালচক এবং মলয় কর্মকারের বাড়ি হুগলীর সিঙ্গুর থানার জগতনগরে।
মেমারির কানাইডাঙার বাসিন্দা চাকরীপ্রার্থী সেখ মইনুল হাসানের অভিযোগে পুলিশ এই ৮ জনকে গ্রেফতার করে। তাঁদের মধ্যে ৩ জনকে ৭দিনের পুলিশী হেফাজতের আবেদন জানানো হয় আদালতে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, ধৃতদের কাছ থেকে নগদ ১ লক্ষ ১০ হাজার ৫০০ টাকা, ২টি রেজিস্ট্রার খাতা, ২টি পেন ড্রাইভ, ৭টি মোবাইল ফোন, ৭টি রাবার স্ট্যাম্প, রাজ্যপাল সহ সরকারী উচ্চপদস্থ আমলাদের কাছে দেওয়া একাধিক চিঠির কপি, চাকরীপ্রার্থীদের প্যানেল লিস্ট উদ্ধার করা হয়েছে। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ধৃতদের ব্যবহৃত গাড়িটিও। তিনি জানিয়েছেন, ২০১৮ সাল থেকে এই চক্রটি ফিউচার ইন্ডিয়া – রোড সেফটি অর্গানাইজেশনের নামে কাজ শুরু করে। এই চক্রের চেয়ারম্যান কলকাতার নিমতা থানার বিরাটি এলাকার দেবকুমার চ্যাটার্জী। চাকরি প্রার্থীদের বিশ্বাস অর্জন করতে বারাসাতের রুবি হাসপাতালে মেডিকেল টেস্ট এবং বারাসাতের প্রজ্ঞালয় হলে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। মূলত রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটলে কিভাবে দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাতে হবে, প্রাথমিক চিকিৎসা কি করতে হবে – সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, গোটা চক্রের কাজকর্ম এবং বাকিদের হদিশ পেতে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।
এদিকে, প্রতারিত যুবক যুবতীরা দাবি করেছেন, ২০১৬ সাল থেকেই এই অর্গানাইজেশন কাজ শুরু করে। তাঁদের একটি ওয়েবসাইটও রয়েছে। যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী সহ রাজ্যপালের ছবিও ব্যবহার করা হয়েছে। প্রার্থীদের কাছ থেকে ৬০ হাজার থেকে সাড়ে চার লক্ষ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি দেওয়ার নাম করে। বলা হয়েছে, সেনা জওয়ানদের সমতুল্য বেতন পাবেন তাঁরা। প্রতারকরা গ্রেফতার হওয়ায় এখন রীতিমত কপালে হাত বেকারদের। তাঁরা দ্রুত টাকা ফেরতের আবেদনও জানিয়েছেন পুলিশের কাছে।