চার বছর আগে যখন তাঁকে প্রথম হলদি দে পাড়ায় দেখা গিয়েছিল তখনও জানা ছিল না তিনি কে? আর পাঁচটা ভবঘুরে, পাগলাটে লোকের মতই কারুশিল্পী কমল কুমার মণ্ডলকে একজন অচেনা অজানা পাগল হিসাবেই দেখতে শুরু করেছিলেন হলদি দে পাড়ার মানুষজন। কিন্তু ধীরে ধীরে গ্রামবাসীরা বুঝতে পারেন, এই ব্যক্তি আর পাঁচ জনের মত নন। কোনো উৎপাতও করেন না। শান্ত স্বভাবের অথচ মানসিক ভারসাম্যহীন। আস্তে আস্তে সেই মানুষটাই হলদি দে পাড়ার বাসিন্দাদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।

সোমবার গোটা রাজ্য জুড়েই পালিত হল রাখি বন্ধন উৎসব। রাখি বন্ধন উৎসব পালন করেছেন বর্ধমানের হলদী দে পাড়ার বাসিন্দারাও। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছরের রাখির দিন একটু অন্যরকমই হয়ে গেল তাঁদের কাছে। গত প্রায় চার বছর ধরে প্রতিদিনের সেই চেনা দৃশ্যগুলোই এদিন বদলে গেল এক লহমায়। এই এলাকাতেই ঘুরে বেড়াতেন মানসিক ভারসাম্যহীন এই ব্যক্তি। কখনও এই বাড়ি তো কখনও রাস্তার চায়ের দোকান – এভাবেই দিন কাটছিল তাঁর। এতদিন ধরে নাম, পরিচয় কিছুই জানত না হলদি দে পাড়ার বাসিন্দারা। জিজ্ঞাসা করলেও মিলত না উত্তর। আর এইভাবে চলতে চলতে কখন যেন তিনি গ্রামের কারও পাগল মামা, কারও পাগল ভাই আবার কারও পাগল দাদা হয়ে গিয়েছিলেন তা কেউ বুঝতে পারেনি। আস্তে আস্তে কোথাও একটা টান অনুভব করতে শুরু করেছিলেন গ্রামবাসীরা।

স্থানীয় পিলখুড়ির বাসিন্দা এবং ভাতারের মহড়া নীলডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌভিক ভট্টাচার্যের হঠাৎই নজরে আসেন এই ভবঘুরে পাগলা মামা। সৌভিকবাবু জানিয়েছেন, অনেক ছোটবেলায় একবার তাঁর এক কাকাকে তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন মাত্র একদিনের জন্য। সেই ব্যথা আজও তাঁর মধ্যে রয়েছে। প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা কি তিনি সেদিন বুঝেছিলেন। তাই বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কার্যত প্রায় ব্রত নিয়ে ফেলেছিলেন এই ধরণের ঘটনা তাঁর নজরে আসলেই তিনি চেষ্টা করবেন। তাঁর সেই সিদ্ধান্তের ফসল – যখন তিনি এই পাগল মামাকে দেখলেন তখন থেকেই তিনি চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিলেন এই ব্যক্তির পরিচয় জেনে তাঁকে তাঁর বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়ার।

সৌভিকবাবু জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই তিনি একটু একটু করে ভাব জমিয়েছেন ওই ব‌্যক্তির সঙ্গে। অর্জন করেছেন তাঁর বিশ্বাস। তারপর জেনেছেন তাঁর নাম ঠিকানা। পাগল দাদার আসল নাম কমলকুমার মন্ডল, পিতা যামিনীকান্ত মন্ডল, বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজ থানার অন্তর্গত বজবজ পুরসভার ১৫নং ওয়ার্ডের বাদেকালীনগর এলাকায়। এরপরেই সৌভিকবাবু যোগাযোগ করেন বর্ধমান থানার আইসি-র সঙ্গে। বর্ধমান থানার সহযোগিতায় এরপর যোগাযোগ করা হয় বজবজ থানার সঙ্গে। এরই পাশাপাশি তিনি যোগাযোগ করেন বজবজ প্রেস ক্লাবের সম্পাদক দীপক ঘোষের সঙ্গে।
তাঁর সহযোগিতায় মেলে কমলবাবুর পরিবারের সন্ধান। পাঠানো হয় কমল মণ্ডলের ছবিও। ছবি দেখে পরিবারের লোকজন নিশ্চিন্ত হন।

কমলবাবুর দাদা সুশীল কুমার মন্ডল জানান, কমল এরকম ছিলো না। ও খুব ভালো কাঠমিস্ত্রি ছিলো। ভালো টাকা রোজগারও করতো। এলাকায় ভালো নামডাকও ছিলো। কিন্তু কাল হল যখন একের পর এক বাবা, মা ও মামাকে পরপর চোখের সামনে হারালো। তখন থেকেই ও নির্বাক হয়ে গেল। কেমন যেন আচরণ শুরু করল। আর হঠাৎই একদিন নিখোঁজ হয়ে গেল। অনেক খোঁজা খুঁজি করেও পাওয়া যায়নি। অবশেষে দীর্ঘ চার বছর পর ওঁর সন্ধান পেয়ে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। আজ রাখী বন্ধন উৎসবের মিলনের দিনে ওকে ফিরে পেয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে।

অন্যদিকে, কমলবাবু বাড়ি ফিরে যাওয়ায় আনন্দের মাঝেই মন খারাপ দে পাড়ার বাসিন্দাদের। তাঁদের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে পাগলা দাদা এটা ভেবেই তাঁদের মন খারাপ। তাই আজকের দিনে সকলেই রাখি পরিয়ে ভালোবাসার বন্ধনকে সুদৃঢ় করে বিদায় জানাল তাঁদের প্রিয় পাগলা দাদাকে। রাখি পড়ালেন স্থানীয় গৃহবধু লক্ষ্মী কোনার। চোখের কোনে জল চিকচিক করে উঠেছিল তাঁর। বাড়ি ফিরে যাওয়ার পথে পাগলা দাদাও বোনদের জানিয়ে যান – আবার ফিরে আসবেন তাঁদের কাছে। তাঁদের ভালোবাসা ভোলার নয়। সোমবার দুপুরে এই গোটা ঘটনার সাক্ষী থাকল বর্ধমান ও বজবজ থানার অফিসার ও বজবজ প্রেস ক্লাবের সদস্যরা।

Like Us On Facebook