রথের দিন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে বেসুরো বাঁশির শব্দে ঘুম ভাঙা এখন ইতিহাস। সেই বেসুরো বাঁশি আর ভেঁপুর শব্দ আজকের প্রজন্মের ছেলেদের আর আকর্ষণ করে না। বাবা-মার ঐকান্তিক ইচ্ছাকে মান্যতা দিতে গিয়েই হারিয়ে যাচ্ছে রথের মেলার সেই অনাবিল আনন্দের দিনগুলো। আর গত বছর থেকে সেই আবেগে সপাটে চড় মারতে শুরু করে দিয়েছে করোনা। এক নিঃশ্বাসে এই কথাগুলো বলে তিনি যখন থামলেন তখন চশমার মধ্যে দিয়েও লক্ষ্য করা গেল দু’চোখ জলে ভরে যাচ্ছে পদ্মাদেবীর। বর্ধমানের রাজবাড়ি এলাকায় তিনি থাকেন। সরকারি চাকরিও করেন। কিন্তু সেই কোন্ ছোটবেলায় বাবা-মার হাত ধরে তিনি আসা শুরু করেছিলেন বর্ধমানের রাজবাড়িতে রাজবাড়ির রথের দড়ি ছুঁতে। আজও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি ঠিকই, কিন্তু গতবছর করোনার জেরে তিনি সেই পূণ্য অর্জন করতে না পেরে মুষড়ে ছিলেন।
বর্ধমান শহরের সোনাপট্টিতে অবস্থিত লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরে রয়েছে রাজ পরিবারের প্রায় ৩৫০ বছরের প্রাচীন দুটি রথ। একটি পিতলের অন্যটি কাঠের। জানা যায়, রাজ আমলে দুটি রথ ছিল। একটি রুপোর তৈরি যা কেবলমাত্র রাণীদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। অন্যটি ছিল পিতলের। যা প্রজাদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। প্রতিবছরই এই লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরের ঐতিহ্য মেনে রাজ পরিবারের সদস্যরা এসে রথের রশিতে টান দিয়ে সূচনা করতেন রথযাত্রা। ঐতিহ্য মেনে আজও পুজো হয়ে আসছে এই রথের। তবে বিশেষত্ব এই যে, রাজবাড়ির রথে থাকেনা ভগবান জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা। পরিবর্তে সেখান অধিষ্ঠান করেন রাজপরিবারের কুল দেবতা।
সোমবার প্রতিবারের মতই স্থানীয় বাসিন্দা পদ্মা দে এসেছিলেন রাজবাড়ির এই রথের রশিতে টান দিতে। তিনি জানিয়েছেন, যেভাবে করোনার দাপট চলছে কবে আছেন কবে নেই তার কোন ঠিক নেই। কিন্তু তিনি এতকাল ধরে যে আবেগকে নিয়ে এই রাজবাড়িতে এসেছেন এদিনও সেই আবেগ নিয়েই এসেছেন। জানিয়েছেন, গতবছর করোনার জন্য রাজবাড়ির সিংহদরজাই খোলা হয়নি। তখনই মনে হয়েছিল করোনা তাঁকে সজোরে একটা থাপ্পড় দিয়েছে। এবারে এসেছেন কিন্তু সেই দুঃখ ভুলতে পারছেন না। তিনি জানিয়েছেন, কেমন যেন সব বদলে যাচ্ছে। রথের সেই মেলা জৌলুস হারাচ্ছে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে রথের বাঁশি, ভেঁপুর প্রতি কোন আসক্তি নেই। নেই রথের মেলায় ঘুরে আনন্দ নেওয়ার তাগিদ। একইসঙ্গে রীতিমত আক্ষেপ আর দুঃখ প্রকাশ করে পদ্মাদেবী জানিয়েছেন, ভেঙে পড়ছে রাজবাড়ি। রথের চুড়ো ভেঙে যাচ্ছে। সংরক্ষণ দরকার। নাহলে হারিয়ে যাবে এই ইতিহাস, স্মৃতি।