গোটা দেশ থেকেই যখন একটু একটু করে বলিপ্রথাকে তুলে দেওয়া হচ্ছে মানবিক কারণবশত, সেই সময় খোদ বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে ইদিলপুরের ঘোষবাড়ির পুজোয় এখনও বলি হয় মোষ, ভেড়া আর ছাগল। আর শুধু যেমন তেমন বলিই নয়, এই ঘোষ বাড়ির প্রায় চারশো বছরের পুরানো পারিবারিক দুর্গাপুজোয় রয়েছে বলি নিয়ে মজার ঘটনা।
ঘোষ পরিবারের গৃহবধু গীতারাণী ঘোষ জানিয়েছেন, ঘোষ পরিবারে দেবী দুর্গার পুজোর প্রচলন হয়েছিল স্বপ্নাদেশ পেয়েই। আর সেই তখন থেকেই দেবীর স্বপ্নাদেশ অনুসারে চলে আসছে পুজোর সমস্ত কর্মকাণ্ড। ঘোষ পরিবারে মোষ বলির আগে ভেড়ার সঙ্গে ঘটা করে মোষের বিয়ে দেওয়া হয়। আর তারপরেই মোষ ও ভেড়ার উভয়েরই বলি দেওয়া হয়। ইদিলপুরের এই ঘোষ পরিবারের পুজোয় দামোদর থেকে ঘট আনা হয়। আবার দামোদরেই তা বিসর্জন করা হয়। এখনও রীতি মেনে বাঁকুড়ার ইন্দাসের শাসপুরের কুশমুড়ি গ্রাম থেকে আসে ৮জন ঢাকি।
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, একবার গণেশের পায়ে রং দেওয়া হয়নি। অথচ পরের দিনই পুজো। দেবী স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন। আর পরের দিন মূর্তির কারিগর ছুটে এসে দেখেছিলেন সত্যিই গণেশের পায়ের তলায় রং পড়েনি। প্রায় ৪০ বছর আগে একবার দেবীকে পোষাক পরিচ্ছদ পড়ানোর সময় তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল ভেঙ্গে যায়। ঘোষপরিবারের সদস্য শ্যামচাঁদ ঘোষ ছিলেন জেনারেল ফিজিসিয়ান। তিনি তা দেখে ব্যাণ্ডেজ করে দিয়েছিলেন। রাতে দেবী তাঁকে স্বপ্ন দিয়েছিলেন। কথিত আছে একবার ডাকাত এসেছিল ঘোষ পরিবারে কিন্তু ডাকাতরা শত চেষ্টা করেও বাড়িতে ঢুকতে পারেনি। সমস্ত দরজায় দরজায় সিংহবাহিনী দেবী দুর্গাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিছু হঠেছিল ডাকাত।
ইদিলপুরের এই ঘোষ পরিবারের দেবী দুর্গাকে নিয়ে অজস্র কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। ঘোষ পরিবারের সদস্য অনুপম ঘোষ জানিয়েছেন, বছর চারেক আগে তিনি পুজোর সময় খানাকুলে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে চণ্ডীপাঠ হওয়ার সময় এক গৃহবধূ তাঁর কাছে এসে বলেন, তিনি ঘোষ পরিবারের দেবী দুর্গা। কিন্তু অনুপমবাবু তাঁকে নাকে নথ আর পায়ে নুপুর না পড়িয়েই চলে এসেছেন। অনুপমবাবু জানিয়েছেন, এরপরই তাঁর মনে পড়ে সত্যিই তিনি দেবীকে নথ আর নুপুর না পড়িয়েই চলে এসেছিলেন শ্বশুরবাড়ি। এমনকি দেবী নাকি সেই সময় তাঁকে বলেছিলেন, কেন তাঁকে মেটে শাড়ি পড়িয়েই রাখা হয়, ঘোষ পরিবারের বউদেরও কি এই শাড়ি পড়িয়ে রাখা হয়? অনুপমবাবু জানিয়েছেন, এরপরই তিনি বেনারসী শাড়ি কিনে দেবীকে পড়িয়ে দিয়েছিলেন।
গীতাদেবী জানিয়েছেন, প্রায় বছর ৩৫ আগে একবার মোষ বলি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই রাতেই দেবী ঘোষ পরিবারের পুরুষ সদস্যদের স্বপ্ন দিয়ে জানিয়েছিলেন কেন এখনও তাঁর বলির জন্য মোষ কেনা হয়নি। আর একবার মোষ কিনে আনার পর তা মারা গিয়েছিল। সেবছর ক্ষীরের মোষ তৈরি করে বলি দেওয়া হয়। আর তারপর থেকে আর বলি বন্ধের আর কোন উদ্যোগ নেওয়ার সাহস করেনি ঘোষ পরিবার। এখানে একচালার প্রতিমা ডাকের সাজ দিয়ে দেবীকে সাজানো হয়। পুজোর বিশেষত্বের মধ্যে রয়েছে ১১ সের চালের নৈবেদ্য দেওয়ার চল।