প্রেমিককে সঙ্গে নিয়ে স্বামীকে নৃশংসভাবে খুন, বারাসাতের হৃদয়পুরের যে ঘটনায় সেই সময় আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল গোটা রাজ্যজুড়ে, হৃদয়পুরের সেই মনুয়াই এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শ্যামা’র ভূমিকায়। স্বামীকে নৃশংস ভাবে খুনের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত মনুয়া বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে বন্দি। ২০১৭ সালের সেই হাড়হিম করা হত্যাকান্ড মনুয়ার কাছে এখন অতীত। তাই হয়তো কবিগুরুর গানে গলা মিলিয়ে নৃত্যের মাধ্যমে মনুয়া মনে হয় বলতে চাইছেন, ‘ক্ষমা করো নাথ,ক্ষমা করো। এ পাপের যে অভিসম্পাত হোক বিধাতার হাতে নিদারুণতার’. ..। নৃত্যের মাধ্যমে যেন তাঁর ভুলের ক্ষমা চাইছেন, প্রায়শ্চিত্ত করছেন মনুয়া। রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে মনুয়া মজুমদার শ্যামা চরিত্রে অভিনয় করছেন। বেশ কিছুদিন রিহার্সাল করার পর শুক্রবার বর্ধমানের উৎসব ময়দানে মনুয়ার নৃত্য নজর কাড়ল দর্শকদের। কখনও ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ আবার কখনও ‘আলোকের ঝর্ণা ধারায়’…. নৃত্য পরিবেশন করে দর্শকদের মোহিত করেন মনুয়া। আবার কখনও একক পরিবেশনায় ‘মধুর মুরুতি’। একপ্রকার গানে নাচে মঞ্চ মাতান মনুয়া।
কারাগারের ‘অন্ধকার’ পরিবেশে আবাসিকদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কারা দপ্তরের পক্ষ থেকে। সেই লক্ষ্যেই কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের আবাসিকদের নিয়ে কাজ করছেন বর্ধমানের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মেহবুব হাসান। মেহবুববাবু জানান, মনুয়া এখন নিয়মিত গান ও লেখা নিয়েই ব্যস্ত। রবীন্দ্র রচনাবলি ও রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে তাঁর আলাদা টান রয়েছে। সংশোধনাগারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে যেমন নিয়মিত অংশগ্রহণ করে ঠিক তেমনই অন্যদের উৎসাহ যোগায়। সম্প্রতি তিনি নিজে একটি ম্যাগাজিন সম্পাদনা করছেন। যে ম্যাগাজিনে সংশোধনাগারের অন্যান্য বন্দিরা নিজেদের মনের কথা লেখেন। মনুয়া সহ অন্যান্য বন্দিদের লেখা কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধে সমৃদ্ধ এই ম্যাগাজিন।
শুক্রবার বর্ধমানের উৎসব ময়দানে মনুয়ার নৃত্যনাট্য মুগ্ধ করে সকলকে। মনুয়া যখন মঞ্চে তাঁর নৃত্যনাট্য পরিবেশন করছেন তখন দর্শকাসনে থিকথিকে ভিড়। অথচ এই মনুয়ার রোমহর্ষক অতীত কাহিনী এখনও মনে পড়লে সকলে শিউড়ে উঠেন। ২০১৭ সালে বারাসাতের হৃদয়পুরে পরিকল্পনা করে প্রেমিককে দিয়ে স্বামীকে খুনের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। ফোনের ওপারে থেকে খুন পর্বের প্রতিটি মুহূর্ত নিজের কানে শুনেছিলেন এই তরুণী। কীভাবে স্বামীকে মারতে হবে সেই টিপসও নাকি তিনিই দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। তারপর পার হয়ে গেছে বহু সময়। সেই মনুয়াই জেল বন্দিদের কাছে এখন ‘আইডল’। কে কোন সংগীতের নৃত্যে কী স্টেপ করবে, কবিতার কোথায় ভুলত্রুটি, প্রবন্ধে কোন্ চরিত্রটাকে কিভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে তিনি তা নিজে হাতে ধরে শেখাচ্ছেন অন্য বন্দিদের।
ডিআইজি কারা(বর্ধমান রেঞ্চ)শুভব্রত চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সংশোধানাগারে রাখার উদ্দেশ্য হল বন্দিদের মননের পরিবর্তন ঘটিয়ে সমাজের মূলস্রোতে তাঁদের ফিরিয়ে আনা। অপরাধমূলক ভাবনা ছেড়ে তাঁরা যাতে সমাজের আর পাঁচটা মানুষ হয়ে ওঠেন, তার জন্য বিভিন্ন রকম কর্মে উৎসাহ দেওয়া। মনুয়ার ক্ষেত্রে সেই উদ্দেশ্য অনেকাংশেই সফল হয়েছে। পুরানো সেই ঘটনা এখন মনেই রাখতে চান না মনুয়া। নতুন করে পথ চলতে চান। সেই কারণেই রবীন্দ্র নৃত্যকে আঁকড়ে নিজের একটা আলাদা জগৎ তৈরী করেছেন তিনি। শুধু তাই নয় ‘খোলা আাকাশ’ নামে একটি ম্যাগাজিন সম্পাদনা করার পাশাপাশি সংশোধনাগারের অভ্যন্তরে অন্যান্য আবাসিকদের জন্য পুতুল, স্যানিটারী ন্যাপকিন, টেলারিং সহ নানান কর্মমুখি প্রশিক্ষণও হচ্ছে মনুয়ার তত্ত্বাবধানে। ইতিমধ্যেই মনুয়া ইতিহাসে তাঁর মাস্টার ডিগ্রি কমপ্লিট করেছেন এবার তাঁর ইচ্ছা পিএইচডি করার, আমরা সর্বতভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি।’