ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশ ও দেশবাসীকে মুক্ত করতে ব্রিটিশদের উৎখাত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে চন্দন গাছের জঙ্গলে ঘেরা খড়ি নদীর পাড়ে গলসির চান্নাগ্রামে ১৯০৭ সাল নাগাদ বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে শ্রীমৎ স্বামী নিরালম্ব প্রতিষ্ঠা করেন এক আশ্রম, যা পরবর্তীকালে চান্না আশ্রম নামে খ্যাতি লাভ করে। তৎকালীন সময়ে এই আশ্রমই ছিল ভারত তথা বাংলার বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গোপন ডেরা। এই আশ্রমে বসেই তৎকালীন বিপ্লবীদের বড়দা যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনান্য বিপ্লবীরা রাতের পর রাত গোপন সভা করতেন। সেখান থেকেই ছকে নেওয়া হত বিপ্লবী কর্মকান্ডের নানান ব্লু-প্রিন্ট। সেই গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী এই আশ্রম আজ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অবহেলিত। কার্যত গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বর্ণময় ইতিহাসের সাক্ষী এই চান্না আশ্রম।

পূর্ব বর্ধমানের গলসির চান্না আশ্রম৷ বিপ্লবীদের আঁতুরঘর। দু’চালার ছোট্ট খড়ের চালের মাটির ঘরটি কালের সাক্ষী হিসাবে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এখন গরু, ছাগল, ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। অনাদরে অবহেলায় ভেঙে পড়ছে। সংরক্ষণে উদ্যোগী না হলে এই ইতিহাস শেষ হয়ে যাবে। তাই চান্না আশ্রমের পরিচালন কমিটি চাইছে সরকার অধিগ্রহণ করুক এই আশ্রম। বাঁচিয়ে রাখুক স্বাধীনতার ইতিহাসকে।

কার্যত অবহেলায় ভগ্নদেহ নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চান্না আশ্রম। চান্না গ্রামের একপ্রান্তে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন এই আশ্রম। যার ভৌগোলিক অবস্থান রয়েছে নজরকাড়া। মনে করা হয়, স্বাধীনতা আন্দোলনের সুবিধার জন্যই তৎকালীন এই নির্জন জায়গাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল ভেবে চিন্তেই। চন্দন গাছের জঙ্গলে ঘেরা এই আশ্রম এলাকা চন্দনা নামে পরিচিত ছিল, পরবর্তীতে চন্দনা-ই চলতি ভাষায় চান্না-য় পরিণত হয়। একদিকে গলসি থানা, অন্যদিকে আউসগ্রাম, ভাতার ও বর্ধমান থানার সীমানায় বসে গোপনে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন তাঁরা। আশ্রম মানে দেশের স্বাধীনতার জন্য গোপন কার্যকলাপ চালানোর আস্তানা। প্রায় ২৫ বিঘে জমির উপর তৈরি হয়েছিল একটি খড়ের চালের ঘর। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ থেকে উজ্জীবিত হয়ে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার মুরারিপুকুরে ব্রিটিশের উপর বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন যতীন্দ্রনাথ। পাঞ্জাবের গদর পার্টির সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখে দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখতেন এই আশ্রমে বসেই। সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানহুর সঙ্গে এখানেই বসে আলোচনা করেছেন দিনের পর দিন। চান্না আশ্রমে এসেছিলেন ভগত সিং, ভগত সিংয়ের বাবা কিষেণ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত, লালা লাজপত রায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, অরবিন্দ ঘোষ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি, রাসবিহারী বসু, জীবনতারা হালদার, যদুগোপাল মুখোপাধ্যয়, সোহং স্বামী, তিব্বতি বাবা, প্রজ্ঞান পাদজী (যোগেশ্বর চট্টোপাধ্যায়), ফকির রায়ের মতো বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী। দিনের পর দিন রাতের পর রাত জেগে তাঁরা দেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করেছেন এই চান্না আশ্রমে বসে।

বাম ও বর্তমান সরকারের আমলে এই আশ্রমের জন্য একবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বেশি দূর এগোয়নি। সবকিছুই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়ছে, নষ্ট হচ্ছে। কয়েক বছর আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুভাষ সরকার ও রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ আলাদা আলাদা ভাবে এসে আশ্রম সংরক্ষণের গালভরা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা প্রতিশ্রুতির পর্যায়েই রয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ আশ্রম পরিচালন কমিটির সম্পাদক প্রণব কুমার সামন্তর।

আশ্রমের বর্তমান পরিচালন কমিটির সভাপতি অমল বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এই আশ্রমে বসেই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপণ করেছিলেন বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ অনাদরে, অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আশ্রমটি অধিগ্রহণ করে সরকার সংরক্ষণ করুক। একই দাবী স্থানীয়দেরও। তাঁদের অভিযোগ, প্রতিবছরই স্বাধীনতা দিবস ঘটা করে পালন করা হয়। কোটি কোটি টাকা খরচাও করা হয়। কিন্তু যাদের জন্য স্বাধীনতা তাঁদের ইতিহাস রক্ষার কোন উদ্যোগই নেওয়া হয়না।

Like Us On Facebook