অস্থায়ী মোবাইল স্কুল। শিক্ষকের স্কুলে ছাত্র নয়, ছাত্রের স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা। খোলা আকাশের নীচে কিংবা আম্রকুঞ্জের নীচে বসেও নয়। একেবারেই জনকোলাহলের মাঝখানেই অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায় চলছে স্কুল। গোটা রাজ্যের মধ্যেই এই মোবাইল স্কুল চালুর উদ্যোগের ঘটনা নজর কেড়েছে সাধারণ মানুষেরও। অনেকেই তাই বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত।

‘সহজপাঠ’। বর্ধমান প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সদর আরবান-২ চক্রের কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকার ঐকান্তিক প্রয়াস। স্থান – বর্ধমান রেলওয়ে ষ্টেশনের ৮নং প্ল্যাটফর্ম। শিক্ষক-শিক্ষিকার তালিকায় রয়েছেন তাপস পাল, অভিষেক মণ্ডল, রুপসান নেহার, রিজিয়া সুলতানা, মানবী রায়, প্রসূন চন্দ্র দাস, সাদ্দাম হুসেন, মুন্না শর্মা প্রমুখরা।

গত সোমবার থেকেই এই ৮নং প্ল্যাটফর্মের এক কোণায় শুরু হয়েছে এই মোবাইল স্কুল। বর্ধমান স্টেশনের পথশিশুদের শিক্ষার মূল স্রোতে ফিরিয়ে নিয়ে আসাই এই সহজপাঠের মূল লক্ষ্য। বর্ধমান সদর আরবান -২ চক্রের সাব ইন্সপেক্টর সুভাশীষ বক্সী জানিয়েছেন, কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকা বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলেন। তা নিয়ে তাঁরা আলোচনাও করেন। পরে গোটা বিষয়টি উত্থাপন করা হয় জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তবের কাছে। তিনি সবুজ সংকেত দেবার পরই শুরু হয় কাজ। বর্ধমানের বিদ্যার্থী গার্লস স্কুলের (প্রাথমিক) শিক্ষিকা মানবী রায় জানিয়েছেন, স্কুলে পড়াতে গিয়ে তাঁরা লক্ষ্য করছিলেন ড্রপ আউট হচ্ছেই। কিন্তু কেন হচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে বাচ্চারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এরপরই তাঁদের নজরে আসে বর্ধমান স্টেশনের পথশিশুদের ওপর। দেখা যায় কয়েকজন ছেলেমেয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করলেও পরে আর যায়নি। তাই এরপরই তাঁরা চিন্তা করেন, এভাবে নয়, শিক্ষকের কাছে ছাত্রছাত্রীরা তো আসেই। কিন্তু এই ড্রপ আউটকে বন্ধ করতে গেলে, শিক্ষার অধিকারকে সত্যিই সকলের মধ্যে পৌঁছাতে গেলে শিক্ষকদের যেতে হবে ছাত্রছাত্রীদের কাছে। আর তাই তাঁরা সোমবার থেকে শুরু করেছেন বর্ধমান স্টেশনের পথশিশুদের নিয়ে এই শিক্ষাদান পর্ব। যার আপাত নামকরণ করা হয়েছে সহজপাঠ। বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনেও হাজিরার সংখ্যা প্রায় ৩০ জন। করণ, সাহাজান, সূজন, বাবলু, গণেশ, পরীরা এদিন রীতিমত উৎসাহের সঙ্গেই শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে পড়াশোনা নিয়ে মেতে উঠল।

মানবী রায় জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত স্বেচ্ছায় প্রায় ২০জনেরও বেশি শিক্ষক শিক্ষিকা এগিয়ে এসেছেন এই কাজে। স্কুলের নির্ধারিত সময়ের পর আপাতত তাঁরা সপ্তাহে ২দিন ১ ঘণ্টা করে এই শিশুদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির কাজ করে যাবেন। এই শিক্ষক দলে রয়েছেন রাজ্যের প্রাথমিক সিলেবাস কমিটির সদস্য সৈকত রাউতও। তিনি জানিয়েছেন, যেহেতু এই শিশুদের বয়স ভিন্ন ভিন্ন। তাই সকলের মত করে সরকারী গাইড লাইন মেনেই তাঁরা নতুন ধরণের সিলেবাস তৈরি করবেন। প্রথম ধাপে তাঁদের ভাল কিছু শোনার অভ্যাস তৈরি করা হচ্ছে। এরপর তাদের ভাল কিছু বলার অভ্যাস করানো হবে। একাধিক গ্রুপে ভাগ করে তাদের আঁকা, গান, ছড়া বলার সহজপাঠ দেওয়া হবে। আর ইতিমধ্যেই এই কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বর্ধমান স্টেশন ম্যানেজার স্বপন আধিকারীও।

শিক্ষক তাপস পাল জানিয়েছেন, এই পথশিশুদের অনেকেই নেশাসক্ত। তাদের নানাভাবে বোঝানো হচ্ছে এর কুফল। পাশাপাশি স্কুলে গেলে কি কি সুবিধা পাওয়া যাবে কিংবা তাদের হাতেকলমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিলে তাদের আর ভিক্ষাবৃত্তি করতে হবে না- এসবই তাঁরা বোঝানোর চেষ্টা করছেন। তিনি জানিয়েছেন, এই চেষ্টার ফলে যে সবাই মূল স্রোতে ফিরবে তেমনটা আশা না করলেও তাঁরা চান যতটা সম্ভব এই শিশুদের শিক্ষার অধিকার দিয়ে জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। তবে এক্ষেত্রেও বড় প্রতিবন্ধকতা শিশুদের বাবা-মায়েরা। রোজগারের আশায় তাঁরা এই শিশুদের দিয়েই নানান কাজ করান। এব্যাপারেও তাঁরা শিশুদের বাবা-মায়েদের সঙ্গেও কথা বলছেন।

Like Us On Facebook